রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০২:২৭ পূর্বাহ্ন
আমার সুরমা ডটকম : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথিতযশা অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হকের পুত্র বই ব্যবসায়ী ফয়সাল আরেফিন দীপনকে হত্যা করা হয়েছে। গতকাল শনিবার শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটে দিনে দুপুরে তাকে জবাই করা হয়। তিনি জাগৃতি প্রকাশনীর মালিক। এর কয়েক ঘন্টা আগে লালমাটিয়ায় শুদ্ধস্বর প্রকাশনীর মালিক আহমেদুর রশীদ টুটুলসহ তিনজনকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে রক্তাক্ত করে পালিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। এদের মধ্যে একজনকে গুলি করা হয়েছে। তারা এখন ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসাধীন। এদের দু’জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। এর আগে গত ফেব্রুয়ারী মাসে বই মেলা থেকে বাসায় ফেরার পথে টিএসসিতে খুন হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক প্রখ্যাত অধ্যাপক অজয় রায়ের ছেলে মার্কিন নাগরিক অভিজিৎ রায়। আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সামনেই অভিজিৎকে কুপিয়ে হত্যা করা হলেও পুলিশ সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেনি। পুত্রের খুনের পর অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, তিনি ছেলে হত্যার বিচার চান না। তিনি বলেন, পুত্র হত্যার বিচার চাই না। বিচারে কি হবে। বিষয়টি রাজনৈতিক। পৃথক এ দু’টি ঘটনার পর পরই পুলিশ, র্যাবসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন এ হামলার নিন্দা জানিয়ে দোষীদের দ্রুত গ্রেফতারের দাবি জানান। আজিজ সুপার মার্কেটের তৃতীয় তলার নিজ কার্যালয়ে নৃশংস খুনের শিকার জাগৃতি প্রকাশনীর মালিক ফয়সল আরেফিন দীপনের ম্যানেজার আলাউদ্দিন জানান, মার্কেটের তৃতীয় তলায় দীপনের প্রকাশনা কার্যালয়। নিচতলায় শো-রুম। গতকাল শনিবার বেলা ১টার দিকে আলাউদ্দিন তৃতীয় তলায় গিয়ে দীপনের সঙ্গে কথা বলেন। ওই সময় দীপন কম্পিউটারে কাজ করছিলেন। সন্ধ্যা সাড়ে ৫টার দিকে আবারো তিনি মালিকের সঙ্গে দেখা করতে যান। গিয়ে দেখেন, অফিসের দরজা বন্ধ। কিন্তু ভেতরে লাইট জ্বলছে। বৈদ্যুতিক ফ্যানও ঘুরছে। অনেক ডাকাডাকির পরেও ভেতর থেকে দরজা না খোলায় তিনি দরজার নিচ থেকে উঁকি দিয়ে দেখেন ভেতরে রক্ত ঝরছে। আলাউদ্দিন সঙ্গে সঙ্গেই টেলিফোন করে বিষয়টি অবহিত করেন মার্কেট কমিটির সেক্রেটারি নাজুকে। তিনি ঘটনাস্থলে ছুটে এসে কয়েকজনকে নিয়ে দরজা ভেঙ্গে ভেতরে প্রবেশ করেন। এ সময় তারা দেখতে পান দীপন রক্তাক্ত অবস্থায় মেঝেতে পড়ে আছেন। তার গলায় ধারালো অস্ত্রের আঘাত। এ অবস্থায় খবর দেয়া হয় শাহবাগ থানা পুলিশকে। পুলিশ তাকে উদ্ধার করে প্রথমে থানায় নিয়ে যায়। সেখান থেকে নেয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সন্ধ্যা ৭টায় জরুরি বিভাগে আবাসিক সার্জন ডা. কে এম রিয়াজ মোর্শেদ দীপনকে মৃত ঘোষণা করেন। নিহত দীপন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হকের পুত্র। নিহত দীপন ১ ছেলে ও ১ মেয়ের জনক। গত ফেব্রুয়ারিতে টিএসসিতে সন্ত্রাসী হামলায় নিহত লেখক ও ব্লগার অভিজিৎ রায়ের ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’ বইটি প্রকাশ করে জাগৃতি প্রকাশনী।এর আগে দুপুরে লালমাটিয়ার সি ব্লকে ৮/১৩ নং হোল্ডিংস্থ পাঁচতলা ভবনের চারতলায় শুদ্ধস্বর প্রকাশনীর কার্যালয়ে ঢুকে এর প্রকাশক আহমেদুর রশীদ টুটুলসহ ৩ জনকে কুপিয়েছে দুর্বৃত্তরা। আহত অন্য দু’জন হলেন লেখক তারেক রহিম ও রনদীপম বসু। তারা বর্তমানে ঢামেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী একটি অনলাইন সংবাদ মাধ্যমের প্রডাকশন এসিস্ট্যান্ট ওয়াকিফুল হক শক্তি জানান, একটি কাজে তিনি বেলা ১ টার দিকে লালমাটিয়ার ওই কার্যালয়ে যান। ঘন্টা খানেক পরে তিনি এবং ওই অফিসের স্টাফ রাসেল অফিসের সামনের রুমে বসে গল্প করছিলেন। বেলা আড়াইটার দিকে অফিসের দরজায় নক করা হলে স্টাফ রাসেল দরজা খুলে দেন। এ সময় মাঝ বয়সি খোঁচা খোঁচা দাড়ি এবং স্বাস্থ্যবান এক লোক তাকে জানায় তিনি বই কিনতে এসেছেন। ভেতরের রুমে প্রকাশকের সঙ্গে কথা বলতে বলায় ওই ব্যক্তি বলেন, তার সঙ্গে এক ভাই আছে। এরপর তিনি বাইরে যান এবং ফিরে আসেন আরো দুজনকে নিয়ে। যাদের বয়স ১৮ থেকে ২০ এর মধ্যে। তারা ভেতরে ঢুকেই দরজা লক করে দেয়। সাথে সাথেই শক্তি এবং রাসেলের মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে অন্য একটি কক্ষে নিয়ে যায়। এ সময় দুর্বৃত্তরা জানায়, তারা প্রকাশককে খুন করতে এসেছে। কোন কথা বলবি না। তাহলে তোদেরও খুন করা হবে। এরপর তারা একটি কালো ব্যাগ থেকে চাপাতি বের করে। চলে যায় পাশের রুমে। যে রুমে কাজ করছিলেন টুটুল ও অপর দুজন। শক্তি বলেন, এ সময় তিনি গুলির শব্দ শুনতে পান। চিৎকারও শুনতে পান। প্রায় ৫ মিনিট পর দুর্বৃত্তরা নিজেদের সঙ্গে আনা তালা বাইরে থেকে লাগিয়ে পালিয়ে যায়। শক্তি তখন পাশের ব্যালকনিতে গিয়ে দেখতে পান নিজ রুমে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছেন টুটুল। বাইরে আসার চেষ্টা করে দেখেন দরজা বাইরে থেকে বন্ধ। চিৎকার করলেও বাইরে থেকে সাহায্যের জন্য কেউ এগিয়ে আসে নি। কি করবেন বুঝে উঠতে না পেরে এক বন্ধুর মাধ্যমে পুলিশের নম্বর সংগ্রহ করেন। ফোন করেন মোহাম্মদপুর থানার ওসিকে। তার মোবাইল ফোন ব্যস্ত পেয়ে তেজগাঁও জোনের ডিসির মোবাইল নম্বরে সাহায্য চেয়ে একটি এসএমএস পাঠান। যাতে তার অবস্থানের কথা উল্লেখ করা হয়। মিনিটের ব্যবধানেই পুলিশ পাঠানো হয়েছে লেখা ফিরতি ম্যাসেজ পান তিনি। প্রায় ১৫ মিনিট পরে পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে তাদের উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসেন। খবর পেয়ে দ্রুত ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসেন পুলিশ, র্যাব, ডিবিসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা। তারা হত্যাকা-ের বিভিন্ন আলামত সংগ্রহ করেন। ঘটনাস্থল শুদ্ধস্বরের কার্যালয় ভবনের সামনের একটি দরজি দোকানের কর্মচারী বলেন, চিৎকার শুনে আমরা ওইদিকে খেয়াল করে দেখি একটি মোটর সাইকেলে করে তিনজন দ্রুত পালিয়ে যায়। নিচের কলাপসিবল গেইটটিতেও তালা মেরে দিয়েছিল হামলাকারীরা। পুলিশ এসে ওই তালাও খোলে বলে জানান দ্বিতীয় তলার কোচিং সেন্টারের এক শিক্ষার্থী। তবে শক্তি বলেন, তিন দুর্বৃত্ত কার্যালয়ের ভেতরে প্রবেশ করলেও দরজার বাইরে আরো দু’একজন নজরদারিতে ছিলো বলে তার কাছে মনে হয়েছে। এদিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সূত্র জানায়, তারেক রহিমের বুকের বাম পাশ থেকে একটি গুলি বের করা হয়েছে। রাত ৯টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত তিনি জরুরি বিভাগের অপারেশন থিয়েটারে ছিলেন। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, তার অবস্থা আশঙ্কাজনক। এ ছাড়া তার মাথা ও হাতে ধারালো অস্ত্রের আঘাত করা হয়েছে। আহমেদুরের মাথা ও হাতে এবং রনদীপম বসুর হাতে ধারালো অস্ত্রের আঘাত রয়েছে।ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার সাংবাদিকদের বলেন, হামলার সময় ওই কার্যালয়ে পাঁচজন ছিলেন। বেলা আড়াইটার একটু পর একটি ফোন আসে। ফোনটি ধরতে না ধরতেই একটি এসএমএসও আসে। সেখানে লেখা ছিল ‘আমাদের বাঁচান’। এ সময় ওয়াসিকুল-এর মোবাইল ফোন থেকে ‘ভাই আমাদের বাঁচান’ এমন এসএমএস আসে। সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ ফোর্স পাঠানো হয়। পরে পুলিশ তালা ভেঙে তাদের উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। ঘটনাস্থল থেকে একটি তাজা গুলি ও খোসা উদ্ধার করা হয়েছে বলে জানান তিনি। তদন্তের আগে হামলার কারণ সম্পর্কে কিছুই বলা যাচ্ছেনা বলে তিনি জানান। এদিকে ঘটনার পর হতাহতদের দেখতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আসেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া। এসময় তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিরাপত্তা বাড়ানোর নির্দেশ দিয়েছেন। ডিএমপি কমিশনার মেডিকেলের নিরাপত্তা জোরদারে মূল প্রবেশ পথে তল্লাশি চৌকি বসানোর পাশাপাশি ও জরুরি বিভাগে ঢোকার ফটকে মেটাল ডিটেক্টর বসাতে উপস্থিত কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেন। এছাড়া পুলিশ কমিশনার চিকিৎসক এবং হতাহতদের স্বজনদের সাথে কথা বলেন ও তাদের সান্ত¦না দেন। এর আগে সন্ধ্যায় ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার শেখ মারুফ হাসান আহতদের দেখতে যান ঢামেক হাসপাতালে। সেখানে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, বই কেনার নামে দুর্বৃত্তরা অফিসে প্রবেশ করে তাদের উপর অতর্কিত হামলা করে। হামলার পেছনে জঙ্গি সম্পৃক্ততা রয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, “এখনও বলার মতো সময় আসেনি। আমরা সব বিষয় তদন্ত করে দেখছি।”এদিকে প্রকাশকদের ওপর হামলার খবর পেয়ে সেখানে ভিড় জমে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন ও এনজি কর্মীদেরও। গণজারণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকারের নেতৃত্বে হাসপাতাল থেকে বিক্ষোভ মিছিল শুরু হয়। শাহবাগ থেকে মিছিল আবারো ফিরে যায় ঢামেক হাসপাতালে।